শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০১:০১ পূর্বাহ্ন

পতাকা বিবর্ণ হচ্ছে মা

ওমর ফারুক শামীম: একাত্তরে সম্ভ্রম হারানো বিবস্ত্র বীরাঙ্গনা মা গায়ে পতাকা জড়িয়ে নিজেকে আবৃত করেছিলেন। মায়েদের অসীম ত্যাগের বিনিময়ে গর্বের যে পতাকা পেয়েছি, তা আজ লজ্জায় বিবর্ণ হয়ে পড়ছে।

নোয়াখালীর এখলাসপুরের আদিম বর্বরতার ভিডিওর দৃশ্য যেন বলছে খুবলে-খামছে পতাকা ছিঁড়ে নিয়েছে হায়েনারা। পতপত করে ওড়া গর্বের পতাকা আজ বিশ্বায়নের বাতাসে লজ্জা নিবারণ করতে পারছে না। অকল্পনীয় এ ঘটনায় ৫৫ হাজার বর্গমাইলের মানচিত্র লজ্জা আর সীমাহীন বেদনায় কুঁকড়ে গেছে। দেশের সচেতন মানুষ গত ৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যারাতের পর থেকে নির্মম চিত্রের ওই ভিডিও দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। নির্ঘুম রজনী কেটেছে অনেকের।

প্রযুক্তির কল্যাণে এই কলঙ্ক লেপ্টে গেছে বিশ্বের সব বাঙালির গায়ে-গায়ে। সভ্য দুনিয়ায় আরো একবার আমাদের পরিচয় হলো আদিম বর্বর পশুতুল্য হিসেবে। হাজারো অর্জনের ভিড়ে এই নির্মম ঘটনা কারো প্রত্যাশা হতে পারে না। ধর্ষণ আর নারীর প্রতি সহিংসতা দেশে ধারাবাহিকভাবে ঘটেই চলেছে। কিন্তু প্রতিকারের গতি মন্থর বলে ঘটনা যেমন ঘটছে, এর নির্মমতার মাত্রাও বেড়ে চলেছে।

পুরুষশাসিত বাঙালির মানসে ৬৮ হাজার গ্রামজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই চলছে চোরাগুপ্তা ধর্ষণ আর নারী নির্যাতনের ঘটনা। মাঝে মাঝে ধর্ষকরা তাদের নির্মমতার মাত্রা বাড়ায় সঙ্ঘবদ্ধভাবে। দু-চারটি আলোচিত ঘটনা বিচারের মুখ দেখলেও অধিকাংশ ঘটনাই বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার জালে বন্দি হয়ে থাকছে বছরের পর বছর। একসময় আইনের ফাঁক গলে অপরাধী পার পেয়ে যায়। তাই এমন হাজারো ধর্ষণ আর নির্যাতনের ঘটনা ভুক্তভোগীরা অপ্রকাশিতই রাখেন। নোয়াখালীর এখলাসপুরের এই নির্মমতাও প্রায় এক মাস আগের। অপরাধীদের নির্বুদ্ধিতায় ফেসবুকের কল্যাণে আমরা ঘটনা জানতে পেরে স্তম্ভিত হয়েছি। দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। কিন্তু যেসব ঘটনা আড়ালেই থাকছে, সেসবের জন্য রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কি দায় নেই? অবহেলা আর আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন না হওয়ায় এই অপরাধের ঘটনা যেমন চলমান, তেমনি আমরা যে অসভ্য জাতি তার পরিচয়টাও উন্নয়নের পোশাক ছিঁড়ে মাঝে মাঝে দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

৪ সেপ্টেম্বর রাতে ফেসবুকে ওই মর্মান্তিক ভিডিওটি পেয়ে এক পলক দেখতেই নিজে মুষড়ে পড়েছি। এরপর রাত ৩টায় ঘটনাটি নিয়ে লেখার চিন্তা করে এর নির্মমতা অনুভব করতে আরো তিনবার দেখেছি ভিডিওটি। ‘এ্যারে আব্বারে- আল্লার দোয়াই লাগে আঁরে ছাড়ি দে…’ নির্যাতিতা নারীর সেই আর্তনাদ বুকে বিঁধে গেছে শেলের মতো। চোখ ভিজে গেছে কষ্ট আর ক্ষোভের পানিতে। ঘটনা¯’লে থাকলে হয়তো আমারও আইনের কথা মাথায় থাকত না। সবকটাকেই আমি খুন করতাম। কারণ পাশবিকতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে ওরা। মনে হয়েছে, চারপাশ ঘিরে থাকা জানোয়ারগুলোর একজনেরও মা-বোন ছিল না, ওরা মানবকুলের নয়। এদের তখনই চিরতরে বিদায় করা উচিত ছিল। ওই নারীকে বিবস্ত্র করার সময় জানোয়ারদের একবারও মনে পড়েনি জননী-জন্মভূমির কথা। আদরের ছোট বোনটির কথা। মনে পড়েনি মমতামাখা নারীত্বের কথা। মনে পড়েনি মাতৃকোলে দুগ্ধ পানে বেড়ে ওঠার কথা।

জননী জন্মভূমি, আমি তোমাকেই বলছি। ওদের এমন অসভ্যতায় বেড়ে ওঠার জন্য কি শুধু ওরাই দায়ী? না, মা তোমারও দায় আছে। তুমি-আমি-আমরা ওদের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পাঠশালায় নিতে পারিনি। ক্ষমতার সুখ আর ভোগবিলাসের প্রাচুর্যে আমরা মমতা আর মানবিকতার বৈকল্যে পড়ে আছি। এ থেকে আমাদের উদ্ধার করবে কে? মা তোমাকে বাঁচতে হলে ক্ষেতের আগাছা যেমন পরিষ্কার করে ফেলতে হয়, তেমনি এদেরকেও পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। হাতে আর সময় নেই। গত চার বছরে দেশে সাড়ে চার হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে (প্রকাশিত)। অপ্রকাশিত ঘটনা তো হিসাব ছাড়া। এই বিপর্যয় মহামারী আকারে আসার আগেই প্রতিকারের প্রকৃত ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, বিবর্তন

ভাল লাগলে সংবাদটি শেয়ার করুন........

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদিত... © কর্তৃপক্ষদ্বারা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত |২০২০|
Design & Developed BY CHT Technology