রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৪৬ পূর্বাহ্ন
সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
এম হাফিজ উদ্দিন খান:
চলতি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ১৮ মার্চ সোমবার আবারও রক্তাক্ত হলো পাহাড়। পাহাড়ে রক্তপাতের বিষয়টি নতুন কিছু না হলেও সোমবারের মর্মন্তুদ ঘটনাটি সংঘাত ও পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানির বিষয়ে নতুন করে ভাবনার উদ্রেক ঘটিয়েছে। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচন শেষে দায়িত্ব পালনরতরা ফেরার পথে দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি সড়কের নয় মাইল এলাকায় দুর্বৃত্তদের সশস্ত্র হামলার শিকার হন। আমাদের গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত খবরে জানা যায়, ৭ জন (মতান্তরে ৬ জন) নিহত ও ১৬ জন (মতান্তরে ২০ জন) আহত হয়েছেন। তবে বিবিসির সংবাদে এই সংখ্যাচিত্র আরও বেশি। শেষ পর্যন্ত যেটুকু জেনেছি তা হলো, চিকিৎসারত আহতদের মধ্যে অন্তত ১০ জনের অবস্থা এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। তারা দাঁড়িয়ে আছেন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
নির্বাচন কেন্দ্র করে ওই হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছে। আমাদের প্রাথমিক ধারণায়ও এমনটি মনে হচ্ছে; কিন্তু একই সঙ্গে এ সন্দেহও রয়েছে- পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের কারণে ফের এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল কি-না। পাহাড়ে ২০১৭ সালের শেষ মাস থেকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের ফের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সর্বশেষ গত ১৫ মার্চ পার্বত্য এলাকা পানছড়িতে একজন ইউপিডিএফ নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এও জেনেছি, ২০১৭ সালের ওই মাস থেকে তখন পর্যন্ত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে প্রাণহানি ঘটেছে ৫২ জনের। এর সঙ্গে যুক্ত হবে বর্তমানের সংখ্যাচিত্র। সংখ্যাচিত্র যাই হোক না কেন, মানুষের হাতে মানুষের প্রাণহানির এসব ঘটনা অস্থিতিশীল পরিস্থিতিরই সাক্ষ্যবহ। পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে আঞ্চলিক দলগুলো বিগত প্রায় দু’বছর ধরে নতুন করে সংঘাতে জড়িয়ে আছে এবং একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। পাল্টাপাল্টি ঘটনাগুলো বিশ্নেষণে দেখা যায়, পরস্পরবিরোধী কয়েকটি পক্ষ এর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট।
কয়েকদিন আগে চলতি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে এই কলামেই লিখেছি। দলীয় প্রতীকে হতে যাওয়া এই নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। এর ফলে কয়েক ধাপে হতে যাওয়া এই নির্বাচনটি হয়ে পড়েছে একতরফা। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বনাম তাদেরই বিদ্রোহী প্রার্থী। কোথাও কোথাও সরকারি জোটভুক্ত অন্য দলের প্রার্থী থাকলেও এ সংখ্যা নগণ্য। কোনো কোনো এলাকায় বিএনপির কেউ কেউ অংশ নিলেও তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এও দেখা গেছে, কোনো কোনো জায়গায় অংশগ্রহণকারীদের অনেকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জন করেছেন। ফলে নির্বাচনটি হয়ে পড়েছে যেন একেবারেই একতরফা। এই একতরফা নির্বাচনে ভোটারের আগ্রহ ক্রমাগত কমছে এবং পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটাই প্রশ্ন ও বিস্ময়সূচক হয়ে পড়েছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ নয়; কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য তা মোটেও কোনো শুভবার্তা বহন করে না। ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়া চলতি উপজেলা নির্বাচনেও ভোটার খরা লক্ষ্য করা গেছে। ভোটারশূন্য নির্বাচন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য কতটা বিব্রতকর জানি না। তবে আমাদের কাছে তা সুখকর নয়।
ভোটারবিহীন এমন নির্বাচন গণতন্ত্রের সৌন্দর্যহানি ঘটিয়েছে এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে প্রশ্নের মুখেও যে ফেলে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। দেশের পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত ১১৬টি উপজেলায় নির্বাচনে বল প্রয়োগ, ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট, কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া ইত্যাদি বহু রকম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আরও বিস্ময় ও উদ্বেগের বিষয় হলো, খোদ নির্বাচন কমিশনেই এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এও নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং রাজনীতির জন্য অশুভ বার্তা। প্রশ্ন হচ্ছে- ভোটকেন্দ্রগুলোতে বহুবিধ অনিয়ম আর ভোটদানে ভোটারদের অনীহার দায়টা কার? এই প্রশ্নের উত্তর জটিল কিছু নয়। নির্বাচন কমিশন এই দায় এড়াতে পারে না। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান অনুযায়ী যে রকম করা দরকার দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে, আমাদের দায়িত্বশীলরা তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানই নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয়। ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে এ নিয়ে প্রশাসনের দ্বন্দ্বের বিষয়টিও এখন আর লুকানো নয়।
ভোটাধিকার প্রয়োগে ভোটদাতাদের উৎসাহে ভাটা পড়া কিংবা তাদের উৎসাহ হারিয়ে যাওয়ার চিত্র ক্রমেই যেভাবে উৎকটরূপ নিচ্ছে, তা জাতির জন্য নেতিবাচক লক্ষণ। জাতীয় নির্বাচন থেকে স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচন পর্যন্ত জনগণের প্রতিনিধিত্বের নীতি হুমকির মুখে পড়েছে- এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ আছে কি? এই পরিস্থিতি চূড়ান্ত বিচারে আমাদের জন্য কতটা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা নির্ণয়ে গবেষণার প্রয়োজন নেই। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যদি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা না যায় এবং নির্বাচন যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হয় ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সবার সমানাধিকার নিশ্চিত করার পথটি মসৃণ না করা যায়, তাহলে ভোটারের হূত আস্থা পুনরুদ্ধার করা যাবে না। নির্বাচন কমিশন, সরকারি দল কিংবা নির্বাচন সংশ্নিষ্ট অন্য সব মহলেরই এ ব্যাপারে দায় থাকলেও মুখ্য ভূমিকাটা তো পালন করতে হবে নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে। একুশ শতকের এই বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আমরা যে রকম নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করছি, তা হতাশার মাত্রা যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি ভবিষ্যৎ নিয়ে নানারকম নেতিবাচক প্রশ্নও দাঁড়িয়েছে।
ফিরে আসি বাঘাইছড়ির ঘটনায়। পাহাড়ি জনপদ বাঘাইছড়িতে যে রক্তগঙ্গা বইয়ে গেল, এর প্রতিকারে দৃষ্টি দিতে হবে উৎসে। পাহাড়ে ফের সংঘটিত এই ঘটনা এটাই পুনর্বার প্রমাণ করল, অস্ত্রধারীরা পাহাড়ে এখনও অনেক শক্তিশালী। এ হামলার জন্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফকে দায়ী করলেও উভয় সংগঠনই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে নির্বাচনে অংশ নেওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির (এমএন লারমা) প্রার্থী ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা বলেছেন, ‘সন্তু লারমার জেএসএসের বড় ঋষি চাকমা নিশ্চিত পরাজয় জেনে সকালে নির্বাচন বর্জন করেন। তাই সন্ধ্যায় সরকারি কাজে নিয়োজিতদের ওপর এই নৃশংস হামলা চালিয়েছে।’ কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (সন্তু লারমা) বাঘাইছড়ি উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চাকমা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এই ঘটনার সঙ্গে আমাদের দূরতম সম্পর্কও নেই। কারণ ওই এলাকায় আমাদের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম কিংবা অবস্থান নেই। ওইটা পুরোটাই ইউডিপিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকা। আর আমরা যেহেতু সকালেই নির্বাচন বর্জন করেছি এবং লিখিতভাবে আমাদের অভিযোগ নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি, সেহেতু আমরা কেন এমন কাজ করব? আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী, গণতান্ত্রিক রাজনীতিই আমাদের আস্থা।’ তবে আমাদের বক্তব্য হলো, এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে যেন রহস্য উদ্ঘাটনে কোনো ভাটা না পড়ে।
যে দৃষ্টিকোণ থেকেই এই মর্মান্তিক ঘটনাটি বিশ্নেষণ করি না কেন, এটা অত্যন্ত পরিস্কার যে, এই হামলা যে বা যারাই করে থাকুক, এর লক্ষ্য যাই হোক, চূড়ান্ত অর্থে ঘটনাটি ফের সতর্কবার্তা দিয়েছে। পাহাড় নিয়ে পাহাড় ষড়যন্ত্রের নানা কথা অতীতে শোনা গেছে। পাহাড় নিয়ে রাজনীতির নানারকম কূটচাল আছে, এও শোনা যায়। বাঘাইছড়িতে কয়েক বছর আগেও ব্যাপক রক্তপাত ঘটেছিল। পাহাড়ে থেমে থেমে এমন মানবিক বিপর্যয়ের জন্য যারাই দায়ী হোক, এর শিকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে সেখানে সহাবস্থান আরও কঠিন হয়ে পড়বে। ঘাতকদের দ্রুত খুঁজে বের করা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর আশার দানা পুষ্ট হয়েছিল। সঙ্গতই এই প্রত্যাশা জেগেছিল, পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ হবে, শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনও সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে নানারকম অভিযোগ আছে, ভিন্ন ভিন্ন মতও আছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল; কিন্তু এর সুফল আমরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পাইনি। পাহাড়ে শান্তির বিকল্প নেই। পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রুপের হাতে যে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে, তা উদ্ধারে নতুন কর্মপরিকল্পনাও জরুরি। অবৈধ অস্ত্রের যে ঝনঝনানি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, অবৈধ অস্ত্র জীবনবিনাশে যেভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, তা নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। ১৮ মার্চ হতাহতের এত বড় ঘটনার পর পাহাড় নিয়ে নতুন করে ভেবে দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া কতটা জরুরি- সেই বার্তাই পুনবার মিলেছে চরম মর্মন্তুদ ঘটনার মধ্য দিয়ে।
১৮ মার্চ পাহাড়ে সংঘটিত মর্মান্তিক ঘটনার দৃষ্টি শুধু নির্বাচনী কোন্দলের দিকে নিবদ্ধ না রেখে আরও গভীরে যেতে হবে। পাহাড়ে রক্ত ঝরছেই। পাহাড়ে শান্তি যে এখনও বহুদূর, বিদ্যমান বাস্তবতা এরই সাক্ষ্য বহন করছে। গত প্রায় ১৫ মাস ধরে পাহাড়ে নতুন করে সংঘাত-খুনোখুনির ঘটনা ঘটতে থাকলেও তা সংশ্নিষ্ট কোনো পক্ষ এবং প্রশাসনের তরফে কোনো কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যদি তাই হতো তাহলে ১৮ মার্চ বাঘাইছড়িতে এত বড় মর্মান্তিক ঘটনা হয়তো ঘটতে পারত না। এবার যে রক্তপাত ঘটল, এর জন্য উৎসে দৃষ্টি দিতে হবে, নতুন করে সবকিছু ভাবতে হবে এবং সেই নিরিখেই দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ১৮ মার্চ বাঘাইছড়িতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের সশস্ত্র হামলায় যারা হতাহত হলেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের পাশে সরকারকে সবরকম সহায়তাদানে দাঁড়াতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সভাপতি, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন
Leave a Reply