শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:১১ অপরাহ্ন

শিক্ষকদের বেতন ভাতাদি এবং বাস্তবিক চিত্র

শিক্ষকদের বেতন ভাতাদি এবং বাস্তবিক চিত্র

পারভীন আকতার: শিক্ষকগণ জাতির গর্ব।জাতি গড়ার হাতিয়ার, তলোয়ারও বলা চলে।কুপ্রবৃত্তী,মনের আঁধার অজ্ঞতা,মূর্খতাকে ছেঁটেছুটে তাঁরা তৈরি করেন একজন আলোকিত মানুষ।প্রাণান্ত চেষ্টায় যতক্ষণ শিক্ষকের হাতে শিক্ষার্থী থাকে ততক্ষণ তারা সৎ,মেধাবী আর তুখোড় থাকে।তাই তো আমরা সবাই বুক ফুলিয়ে দারুণ দারুণ অভিজ্ঞতার কথামালায় লিখতে বা বলতে পারি আমার ছাত্রজীবন বা আমার প্রিয় শিক্ষক নামের আখ্যান,রচনা।দশে দশ পেয়েছি অনেকবার।এমন লেখা লিখেছি শিক্ষক তুষ্ট হয়ে নম্বর পুরোটাই দিয়ে দিলেন।আর সেই শিক্ষার্থী একদিন সচিব হলো।শিক্ষক যেকোন একটা কাজে তার কাছে গেলেন,সচিব বলে কথা। চেয়ার থেকে উঠা তো দূরের কথা, বললেন কিছুক্ষণ পর আসেন।স্যার বলে সম্বোধন করারও প্রয়োজন মনে করেননি সেই আমলা।ওয়েটিং রুমে বসে আছেন তিনি,কখন তাঁর প্রিয় ছাত্র ডাকবে সে আশায়।ছাত্র এতো আমার ছেলে। ওভাবেই তো মানুষ করেছি,কত অধিকার না জানি শিক্ষকের।সেই করিডোরে আরেকজন আমলা হেঁটে যেতে দেখলেন সেও তাঁরই আরেকজন প্রিয় ছাত্র।সে সবার সামনে স্যারকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, পা ছুঁয়ে কুর্নিশ করলো।শিক্ষকের চোখের জল আর দোয়া একাকার মিশে গেছে যেন আকাশ হাতে পাওয়ার আনন্দ। এই তো একজন শিক্ষকের পাওয়া!আর কী চায়?ঘটনাটা আজ এখানেই শেষ করছি।পরে কোন একসময় পুরো ঘটনাটা লিখবো।খুবই ইন্টারেস্টিং ইতিহাস।যাক আজকের লেখার প্রসঙ্গ অবতারণা করি।

যে শিক্ষক ক্যাডার তৈরি করেন তাঁকে কয় টাকা বেতন দিয়ে পুষছেন খেয়াল করবেন আশা করি।একটি স্কুলে যদি তিনশত শিক্ষার্থী থাকে শিক্ষককের বেতন যদি বিশ বা পঁচিশ হাজার হয় তবে পার হেড স্টুডেন্ট শিক্ষাদানে কয় টাকা পড়ে হিসেব করুন।চাকরীর শুরুতে এই বেতন নামক কচ্ছপের দাম আরো অনেক কম। এবার আসি ভাতাদি!আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে একটি ছয়জন বিশিষ্ট পরিবারের পুরো খরচ খাওয়া,কাপড়চোপড় ,লেখাপড়া,চিকিৎসা বাবদ বর্তমান যুগে কতটা ব্যয়বহুল সাধারণ জীবনযাপনেও যে বেতন দেয়া হয় তা চেয়ে দ্বিগুণ খরচাপাতি জোগান দিতে হয় শিক্ষকদের।টিউশনি করে করে জীবনের সখ আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়ে সময়কে টাকার মেশিন করা ছাড়া তাঁদের উপায়ন্তর নেই আর।দিন মজুরের চেয়ে কোন অংশে কম নয় একজন মহৎপ্রাণ জ্ঞানসারথি শিক্ষক।শুধুই পার্থক্য তাঁরা মাঠে ঘাটে কাজ করেন না। মানুষের ঘরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ান আর স্কুল কলেজের চাকরী করেন।অনেক সময় এটাও অনেক বড় অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়।কেন বাড়ীতে স্পেশাল পড়াবেন শিক্ষকরা?স্পেশাল পড়া আর একশজনের ভিতর পড়া কখনোই এক হতে পারে না।বাড়তি যত্ম নিলে গাছ সুন্দরভাবে বাড়ে।গার্ডিয়ানরা বুঝেশুনেই শিক্ষক নিয়োগ দেন।জোর করে কেউ কারো সন্তান পড়াতে যায় না।শিক্ষকরা লোভী কী জন্য জানেন?পথে একটি বড় করে সালাম পান এই লোভ!সম্মান ও শ্রদ্ধা পান অবিরাম।বেতন কিন্তু একজন সিএনজি চালকের চেয়েও কম!প্রতিদিন হিসাব করেন একজন শিক্ষকের কয় টাকা বেতন?নতুনদের ৬০০ টাকা আর চাকরীর বয়স বেশি হলে হাজারের এদিক সেদিক।সেই টাকা দিয়ে মা বাবা এবং সন্তানাদি, ভাইবোনকে পড়ালেখা,খাওয়ানো, বিয়ের খরচা,পজিশন গড়ে দেয়ার খরচা, চিকিৎসার খরচা, একটি বাড়ী করার স্বপ্ন কি আদৌ মেটানো সম্ভব?পথে পথে বলে বেড়ান শিক্ষকরা খুব সুখী,কোন চিন্তা নাই তাঁদের।মাস শেষেই টাকা ব্যাংকে ঢুকে যায়।আরো কত কথা!আরে বাবা, মাস শেষের দশদিন শিক্ষকদের দেনা করে চলতে হয় সেটার খবর কে রাখে।যে বেতন দেয় সরকার তা পনেরো দিনে শেষ হয়ে যায়! এটাই বাস্তব।বাকীটা চলতে হয় টিউশনির টাকা দিয়ে নতুবা ধার দেনা করে।পরিবারহীন এমন কোন মানুষ আছে নাকি শুধু সাধু সন্ন্যাসী ছাড়া?আর শোনোন চাকরীটা কারো দয়ায় পাইনি আমরা।মেধার স্কোরে পেয়েছি।আল্লাহ সহায় আছেন বিধায় এখনো সদর্পে চলছি।

মাসে দুইশত টাকা টিফিন খরচ!ভাবতে পারেন।দৈনিক ৮ ঘন্টা পড়িয়ে দুইবেলা চা বিস্কুট দিয়ে গলা ভিজাতেও ৩০ টাকা লাগে। মাসে ৯০০ টাকা।হাজারের ঘরে নাই বা গেলাম।তারপর চিকিৎসা খরচও যত সামান্য।নিজের ঔষধ আর ডাক্তার খরচও এর চেয়ে দ্বিগুণ টাকা যায়।আর বাসা ভাড়া যা ধরা হয়েছে তার চেয়ে তিনগুণ বেশি।বলতে পারেন যে বেতন সে মোতাবেক চললেও তো হয়।তাহলে বলেন আমরা কি বস্তিবাসী হবো?মহান জাতি গড়ার কারিগরদের এই দশা।আরেক বৈষম্য লক্ষণীয় শিক্ষকতা পেশায়ও।যাঁরা বেশি কষ্ট করেন সরকারীভাবেই বলছি তাঁরা সবচেয়ে কম বেতন পান।মানে প্রাথমিক শিক্ষকগণ।তারপর ভার্সিটির বুঝদার শিক্ষার্থীদের পড়াতে বেতন দেন লাখ টাকা!আমার প্রশ্ন কেন এই বৈষম্য? আমাদের ভার্সিটি পড়ুয়াদের শিশু থেকে কিশোর বয়সে পড়াতে কষ্ট হয়নি বলছেন?সব কষ্ট কি উনারায় করছেন?এ তো মায়ের পেট থেকে আঠারো বছরের শিশু প্রসব করার মতো ঘটনা হলো!তাই না!দেখুন কত অবহেলিত শিক্ষকগণ।একই প্ল্যাটফর্মে ভিন্ন ভিন্ন সুযোগ সুবিধার আয়োজন।কেউ অহমিকায় মরছে আবার কেউ ক্ষুধার জ্বালায় মরছে।আর এমপিও আর নন এমপিও শিক্ষকদের দূর্বিষহ জীবনের কথা নাই বা বললাম।উনাদের দিকে জাষ্ট তাকানো যায় না।কত যে কষ্ট করছেন তাঁরা!শুধু শিক্ষকতা পেশা সম্মানজনক বলেই তা আকঁড়ে মান মর্যাদায় বাঁচতে চান বলে চাকরীর মন্দা বাজারে এই ছাল চুলোহীন ঘানী টানতে বাধ্য হচ্ছেন।সন্তানদের নামমাত্র শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করা হয়।একজন কলেজ পড়ুয়া সন্তানের কতটা খরচ বহন করতে হয় তা মা বাবার পেটে পিঠের চামড়া এক করে ফেলে রক্ত দিয়ে পড়ানোর মতো অবস্থা হয়।দুটো সন্তানের বেশি খুব কম শিক্ষকের প্রজন্ম আছে।অথচ একজন জ্ঞানীর বংশধর থাকা উচিত অনেক।যাতে জ্ঞানীর গর্ভেই জ্ঞানী আসে।আমাদের দেশে এটার পুরো উল্টো দৃশ্য দেখা যায়।নিরক্ষর মানুষের,অভাবী শ্রমিকদের সন্তান কম হলেও এক দেড় হালিতো হবেই।এরা কি সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে?মদ গাঁজাখোর হয়ে সন্ত্রাসী হচ্ছে।দেশের পতন ঘটাচ্ছে এই কুপরিবেশের সন্তানরা।ধর্ষণ থেকে শুরু করে রাহাজানি সব এদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে।একটার সাথে একটার কত কানেকশন ভাবা যায়!তবুও ভালো যে সরকারই আসে শিক্ষকদের কথা বিবেচনা করে বেতন বাড়িয়ে সামান্য হলেও পানিতে চিনি ঢেলে শরবত মিষ্টি করেন যাতে শিক্ষকরা আশায় থাকেন আরেকটু চিনি ঢালার।খেঁজুর রস খাওয়ার মতো হা করে শিক্ষকরা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করেন,কখন এক ফোঁটা রস পাবেন,পুরো পরিবার তৃপ্তি ভরে খাবে।

আমার দুঃখই লাগে ভিতরের কান্না কষ্ট না বুঝে মানুষ কত সহজে বড় বড় কথা পাড়ে!অদ্ভুত তাদের বোধ বিবেচনা।আর সবারই সংসার আছে,আসা যাওয়ায় গাড়ির পথ।কত দূর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে শিক্ষকগণ।একটু ধৈর্য ধরার মতো কি জনগণ বা সভাসদের যেন মানবিক গুণাবলীর নিম্নগতি হয়েছে! শিক্ষকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সারাদিন গরুর মতো খাটাখাটুনি করলেও সেই অপবাদ, দশ মিনিট লেইট!আরে বাবা,শাড়ীর আঁচল যখন গাড়ীর চাকায় প্যাঁচিয়ে যায়,গাড়ি যদি ধীরে চালায়,তাড়াহুড়োতে রান্নার সময় যখন হাতে ফুসকা পড়ে তখন তো সমবেদনা জানানোর কেউ থাকে না!আরো উস্কিয়ে দেয়ার লোকের অভাব থাকে না।খারাপটা না ভেবে কী ঘটনা বিশদ জানুন।কতটা অসহায় রেখে নিজের সন্তানদের,অসুস্থ মুরুব্বিদের যেনতেন অবস্থায় ফেলে রেখে চলতে হয় চাকরীর পথে আমাদের।এখন আবার বলবেন,তাহলে চাকরী ছেড়ে দিন।শোনোন,আমাদের এ ইগো সমস্যা।চাকরীজীবী সকলেরই একই হাল।সবাই ঘরে বসে থাকলে দেশ গঠন করবে কারা,ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানুষ করবে কারা? ভেবে দেখবেন চোখ বন্ধ করে পাঁচটি মিনিট।শিক্ষকদের নিয়ে নাক চুলকানো,মুখরোচক কথা বলা বন্ধ হউক।জাতি গড়ার মহান কারিগরদের সাধারণের কাতারে নিয়ে আসবেন না দয়া করে।তাঁরা আজীবন দিয়েই যাবেন বিনিময় না পেলেও কখনোই মুখ ফুটে বলবেন না।

সত্যিকার শিক্ষকতা পেশা সম্মানজনক করার জন্য একটি আকর্ষণীয় প্যাকেজ ঘোষণা করুন যাতে উন্নত জীবনযাপন করার গ্যারান্টি থাকে।শিক্ষকদের যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কিছুই ভাবতে না হয়।নতুনরা ক্যারিয়ার গড়তে যেন শিক্ষকতা পেশাকেই সবার আগে চয়েস করে।সুযোগ আপনারা তৈরি করে না দিলে পথে পথে ভবঘুরের মতো বয়ে বেড়াতে হবে বইয়ের বোঝা,জ্ঞানীর জ্ঞানের বোঝা।আমরা মৃত্যুর আগেই নিজেদের সম্মান,যথাযথ মর্যাদা চাই।স্বচক্ষে দেখে যেতে চাই শিক্ষকদের সুখ শান্তির জীবন।আমাদের সব দাবী রাষ্ট্রের কাছে।আশা করি একদিন না একদিন রাষ্ট্র মমতা ভরে শিক্ষকদের বুকে আগলে ধরবে, স্থায়ীভাবে সব ভার বহন করবে।তখনই একটি উন্নত বিবেকবান,সৎ জাতি তৈরি হবে। তখন রচিত হবে একেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জুলুমহীন,টর্চারহীন আত্ম সম্মানের ফুল বাগান, সাফল্যের বাতিঘর।
লেখক: শিক্ষক ও কবি।

ভাল লাগলে সংবাদটি শেয়ার করুন........

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদিত... © কর্তৃপক্ষদ্বারা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত |২০২০|
Design & Developed BY CHT Technology