বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:১৭ পূর্বাহ্ন
দিদারুল আলম রাজু: সাত দিন নয়, সাত মাসও নয়। টানা সাত বছর ধরে বিভৎস সাজা ভোগ করছে জামাল। তবে কাউকে খুন করেনি সে। যেভাবে দু’পায়ে শেঁকল পেঁচিয়ে তালা দিয়ে তাঁকে বেঁধে রাখা হয়েছে কারা অভ্যন্তরে কোনো দুধর্ষ কিংবা মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকেও এভাবে রাখা হয় না। দু’পায়ের মধ্যে দুই ইঞ্চিও ফাঁকা নেই। এভাবে বন্দীভাবেই নাওয়া-খাওয়া, আহার নিদ্রা এবং মলমূত্র ত্যাগ করতে হয় তাঁকে। এখানে কেবল মানবিকতাই হেয়ে যায়নি, এই বাস্তবতা অমানবিকতাকেও ছাপিয়ে গেছে। তবে এই নির্মম আচরণের নেপথ্যের হেতুটা আসলে কী? জানা জরুরী…
অন্য কেউ নয়, আপন পিতা ও ভাইয়েরাই তাঁকে এভাবে বেঁধে রেখেছেন। কারণ হিসেবে পরিবারের সদস্যরা জানালেন, ছেড়ে দিলেই নাকি পাগলামি করে জামাল। মানুষের ঘর-বাড়িতে গিয়ে উৎপাত করে, জামা-কাপড় নিয়ে আসে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি বলি কী, পাগলামি তো পাগলই করবে নাকি! অন্য আট-দশ জনার মতো স্বাভাবিক হলে কী আর কেউ পাগলামি করে। আর পাগলামি করে বলেই কী এভাবে তাঁকে বেঁধে রাখা সমীচীন? এই বেঁধে রাখাটাই কী এর সমাধান?
জামালের বয়স এখন বত্রিশ। টগবগে এক যুবক। তবে ‘পাগল যুবক’। লোকে তাঁকে পাগল বলে। মেধাবী জামালের পাগল হয়ে ওঠার পেছনের গল্পটা ঠিকঠাকভাবে আসলে কারো কাছ থেকেই জানতে পারিনি। তবে ‘পাগল’ হিসেবে পরিচিত জামালের সাথে কথা বলে এবং জামালের বাবা, ভাই এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে যেটুকু জেনেছি সেটুকুই সংক্ষেপে জানাই আপনাদের।
খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙা উপজেলার তবলছড়ি ইউনিয়নের প্রাক্তন মেম্বার মো. জালাল হোসেন। বাড়ি ৫নং ওয়ার্ডের কুমিল্লাটিলা খান মোহাম্মদ মজুমদার পাড়া। জালাল মেম্বারের নয় ছেলে মেয়ে। এর মধ্যে জামাল হোসেন চতুর্থ। জামালের পিতার দুই সংসার। অবশ্য প্রথম স্ত্রী’র মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন জামালের পিতা। প্রথম ঘরে সাত ভাই-বোন এবং দ্বিতীয় ঘরে দুই ভাই-বোন জামালের। জামালের বয়স যখন ঠিক দু’বছর তখনই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়।
মেধাবী হলেও মায়ের শূন্যতা প্রভাব ফেলে জামালের জীবনে। শৈশব থেকেই বেশ দুরন্ত আর দস্যি ছিলো সে। ক্লাস সিক্স অব্দি পড়াশুনাটা ঠিকঠাক চালিয়ে গেলেও এরপর বাঁধে বিপত্তি। সঙ্গ দোষে পাল্লায় পরে হুটহাট কাউকে কিছু না বলে একদিন চট্টগ্রামের হাটহাজারি চলে যায় সে। সেখানে গিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় বয়ের কাজ নেয়। এরপর আর কয়েক বছর বাড়ি ফিরে আসেনি। কয়েক বছর বাদে মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসতো, দুয়েকদিন থেকে আবার চলেও যেতো হাটহাজারিতে। এভাবেই ছাত্র জীবনের ইতি ঘটে তাঁর। ধীরে ধীরে ছন্নাছাড়া জীবনের সাথে যুক্ত হয় মাদক। গাঁজার নেশায় আসক্ত হয়ে পরে তরুণ বয়সে। এরপর কেটে গেলো আরও কিছু বছর। সময়ের পরিক্রমায় এক তরুণীর সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে যায় জামাল। উভয় পরিবারের সম্মতিতে ২০১০ সালে হাটহাজারীতেই বিয়ে করে ওই তরুণীকে। হাটহাজারীতে একটি ভাড়া বাসায় শুরু হয় সংসার৷ আর দু’বছর পর কন্যা সন্তানের পিতা। তবে সংসার জীবনের সুখ টেকসই হলো না নেশার কারণে। ২০১৪ সাল থেকে সে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকে। এরপর জামালকে নিয়ে আসা হয় তবলছড়ির কুমিল্লাটিলায় পৈতৃক বাড়িতে। স্ত্রী’র সাথেও ইতোমধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তাঁর।
কিছুদিন পরপর শেঁকল ছিঁড়ে পালিয়ে যায় সে। আবার তাকে ধরে এনে এভাবেই বেঁধে রাখা হয়। ২০১৪ থেকে ২০২১, এভাবেই চলছে। সারাদিনে দু’বেলা ভাত আর একবেলা নাস্তা দেয়া হয় তাঁকে। তাও জামালের ভাগের ভূমি বিক্রির টাকায়। তবে এ জীবন বিভৎস আর যন্ত্রণার। এমন জীবন থেকে মুক্তি চায় জামাল। সুস্থ্য, সুন্দর ও মুক্ত জীবনের আর্তি তাঁর। তবে প্রশ্ন হলো- ‘এ শেঁকল খুলবে কে?’
জামালের প্রতিবেশীদের কয়েকজন একটি তথ্য দিয়েছেন। প্রতিবেশীরা বলছেন এর পেছনে সম্পত্তিজনিত রহস্য রয়েছে। অবশ্য সেই রহস্যের কোনো সূত্র আমি ধরতে পারিনি বা ধরার চেষ্টাও করিনি। এটা আমার কাজও নয়। প্রশাসনের কর্তারা আশাকরি বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে উদঘাটন করবেন।
লেখক: দিদারুল আলম রাজু, সাংবাদিক ও লেখক।
Leave a Reply